মধ্যযুগের সোনালী দিন
বিসমিল্লাহীর রহমানির রহিম
প্রথম অধ্যায়
ইসলাম মধ্যযুগের বর্বরতা নয় সোনালী সভ্যতা
মধ্যযুগে পৃথিবীব্যাপী ধর্মীয় মতাদর্শের অবস্থান—
মধ্যযুগের দ্বীন ইসলামের প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠা বিষয়ে সঠিক ধারণা বা জ্ঞানার্জন করার জন্য দ্বীন ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে পৃথিবীব্যাপী কোথায় কোন ধর্ম ছিল, সে সকল ধর্মমতের অনুসারীদের কৃষ্টি–কালচার জীবন যাপন প্রণালী এমনকি শাসক শ্রেণীর শাসন প্রণালী সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকা প্রয়োজন। এ বিষয়ে সঠিক ধারণা না থাকলে দ্বীন ইসলাম কিভাবে পৃথিবীব্যাপী প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে এই বিষয়ে সঠিক জ্ঞান লাভ সম্ভব হবে না। আর এ বিষয়ে সঠিকভাবে না জানার কারণেই আমরা ইসলাম বিরোধী রাজশক্তির ষড়যন্ত্রের মাত্রা ও কৌশল সম্পর্কে সঠিক তথ্য উপাত্ত বুঝতে সক্ষম হই না। দ্বীন ইসলামের আবির্ভাবের সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) ও সাহাবায়ে আজমাইনগণের সাথে ইসলাম বিরোধী চক্র যেরূপ বিরোধিতা করেছে দেড় হাজার বছর পর আজও সেই আচরণ সেই বিরোধিতা হচ্ছে। কিন্তু কৌশল ভিন্ন হওয়ার কারণে আমরা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারছি না। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় মুসলিম উম্মাহর সদস্যরা সঠিক পথ থেকে দিকভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
মধ্যযুগের শুরুতে পৃথিবীব্যাপী প্রধান প্রধান ধর্মমত ছিল ইহুদি, খ্রিস্টান, অগ্নি উপাসক ও মুশরেক বা মূর্তিপূজারী। পর্যায়ক্রমে এদের ধর্মমত ও তাদের নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ড সম্পর্কে আলোচনা করছি।
১। ইহুদি ধর্মমত ও অবস্থান
আল্লাহর তালার ওহীর কিতাব প্রাপ্ত ধর্মমত অনুযায়ী মুসলিমরা তাদেরকে আহলে কিতাব হিসেবে গণ্য করে। মূসা (আঃ) এর উম্মত তথা বনী ইসরাইল সম্প্রদায় মধ্যযুগের পূর্বেই তাদের রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাদের একক কোন ভূখণ্ড বা তাদের নিয়ন্ত্রিত কোন রাষ্ট্র ক্ষমতা ছিল না। তারা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করত। রাষ্ট্র ক্ষমতা না থাকলেও তাদের মেধা ও কুটকৌশলের অভাব ছিল না। মেধা ও কূটকৌশলকে কাজে লাগিয়ে তারা সকল স্থানে শাসকগোষ্ঠীকে নিজেদের আয়ত্তে বা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করত। অনেক ক্ষেত্রে তারা সফল হতো, আবার কখনো কখনো হিতে বিপরীত হয়ে শাসক চক্রের রোষানলে পরে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হত। মধ্যযুগের অনেক পূর্ব থেকে তারা যে অঞ্চলেই থাকুক না কেন আর্থিক ভাবে বেশ সচ্ছল ছিল।
কারণ তারা নিজেদেরকে অনেক উত্তম মনে করত, তারা সৃষ্টিকর্তার বিশেষ নেয়ামত প্রাপ্ত বিধায় পৃথিবীর সকলের ধন–সম্পদে তাদের ন্যায্য অধিকার আছে। তারা যে কোন কৌশলে যে কোন জাতি বা সম্প্রদায়ের ধন–সম্পদ নিজেদের অধিকারভুক্ত করে নিলে এতে তাদের কোন অন্যায় হয় না। অর্থ লগ্নী ও সুদী কারবার ছিল ইহুদিদের প্রধান পেশা। সংখ্যায় তারা অল্প হলেও মেধা ও কুটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ ভালোভাবে অবস্থান করত।
পৃথিবীর যেকোনো দেশের কোন ব্যক্তি যেমন অতি সহজে যে কোন ধর্মমত গ্রহণ করে সেই ধর্মমতের অনুসারী বা বিশ্বাসী হয়ে যায়, ঠিক তেমনি ভাবে অতি সহজে ইহুদি ধর্মমত গ্রহণ করে ইহুদী হওয়া যায় না। তাই দেখা যায় ইহুদী ধর্মমতে লোক সংখ্যা একটি নির্দিষ্ট জাতি গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করার মত মেধা যোগ্যতা ও ধৈর্য তাদের আছে। তারা কোন কিছুর চালক না হলেও চালককে নিয়ন্ত্রণ করার কুটকৌশল তারা আদিকাল থেকেই বেশ ভালো জানে।
দ্বীন ইসলামের আহবানে খুব অল্প সংখ্যক হাতে গোনা কিছু ইহুদী পন্ডিত ও সাধারণ ইহুদী সাড়া দিয়েছিল, দ্বীন ইসলাম কবুল করে ভালো মুসলিম হয়েছিল। মধ্যযুগে ইহুদী শাসনে কোন রাষ্ট্র খুঁজে পাওয়া যায় না, বিভিন্ন দেশে তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করত। আধুনিক যুগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইসলামবিরোধী শক্তি তথা ইউরোপীয় ক্রুসেডাররা দ্বীন ইসলামের অনুসারী মুসলিম সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্যই মূলত মধ্যপ্রাচ্যে ইজরাইল নামক ইহুদি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছে। মুসলিম বিশ্বের শরীরে বিষ ফোঁড়ার মত ইহুদী রাষ্ট্র আজ মুসলিম জনসাধারণকে উদ্বাস্ত বানিয়ে দিয়েছে।
২। রোমান সাম্রাজ্য ও খ্রিস্টান ধর্মমত
দ্বীন ইসলাম আগমনের আগে রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টান ধর্ম ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। খ্রিস্টধর্ম মূলত ইহুদি ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত হয়ে যিশু খ্রিস্টের শিক্ষা প্রচারের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এর অনুসারী হিসেবে খ্রিস্টধর্ম ওহী প্রাপ্ত, দ্বীন ইসলাম তাদেরকেও আহলে কিতাব হিসেবে গণ্য করে।
প্রথমদিকে রোমান সম্রাটগণ খ্রিস্টধর্মকে নিপীড়ন করলেও চতুর্থ শতাব্দীতে সম্রাট কনস্টান্টাইন এটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেন, ফলে রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলগুলোতে ব্যাপকভাবে খ্রিস্ট ধর্মের প্রসার লাভ করে। পরবর্তীতে রোমান সাম্রাজ্যে সরকারি ধর্মে পরিণত হয়। তবে মধ্যযুগের শুরুতে খ্রিস্টধর্ম মূলত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক হয়ে পড়ে, যেখানে রাজনীতি ও ধর্ম একাকার হয়ে গিয়েছিল। খ্রিস্টধর্ম মানবতাবাদ, প্রেম ও ক্ষমার বাণী প্রচার করলেও রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে এটি মাঝে মাঝে গোঁড়ামি ও দমননীতিতে পরিণত হয়েছিল।
আহলে কিতাব বা আসমানী কিতাব সম্মিলিত খ্রিস্টধর্ম হলেও সময়ের পরিবর্তনে ওহীর বিধি–বিধান থেকে তারা অনেক দূরে সরে এসে মানব রচিত বিধি–বিধানকে কিতাবের বিধান বলে প্রচার করে। বিভিন্ন শাসক শ্রেণী ও ধর্মীয় পুরোহিতরা নিজেদের স্বার্থে ধর্মীয় বিধি–বিধান ব্যবহার করার ফলে সর্বসাধারণের মানুষ ধর্মীয় যাঁতাকলে পৃষ্ঠ হতে থাকে।
পুরোহিততন্ত্রের কারণে সাধারণ মানুষ খ্রিস্ট ধর্মের দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। ক্যাথলিক ও অর্থোডিক্স, এই দুই ধারার মতলম্বীদের মাঝেও অনেক সময় যুদ্ধ–বিগ্রহ লেগে যেত। রোমান সাম্রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল ছিল ক্যাথলিক খ্রিস্টান। আর পূর্বাঞ্চলের বাইজেন্টাইন অংশ ছিল অর্থডিস্ক খ্রিস্টান। এ কারণে দেখা যায় রোমান সাম্রাজ্যের এ দুই অংশের মতবিরোধ বিরাজ করত। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অঞ্চলগুলোতে খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারীরা ক্যাথলিকদের দ্বারা ব্যাপকভাবে নির্যাতনের শিকার হত। গির্জার পাদ্রী ও চার্চের সন্ন্যাসীদের মধ্যে সর্বদাই গোলযোগ লেগেই থাকতো। একটি অন্যের গীবত করে বেড়াত।
এ সব ধর্মীয় পুরোহিত পাদ্রী বা সন্ন্যাসী যাই বলা হোক না কেন, তাদের প্রধান কাজ ছিল ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের ক্ষমতা সুসংহত করা। ধর্মীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজেদের কর্তৃত্ব জাহির করে সাধারণ মানুষকে শোষণ করা। তাদের এই অন্যায় লোভ লালসার শিকার হয়ে সাধারণ মানুষ খ্রিস্টীয় ধর্মমত থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে থাকে। ঠিক এই সময়ে দ্বীন ইসলামের পতাকা নিয়ে ইসলামী খেলাফত তাদের সামনে হাজির হয়ে যায়।
৩। পারস্য সাম্রাজ্য ও অগ্নিপূজা (জরথুষ্ট্রবাদ)
পারস্যে ইসলাম আগমনের আগে প্রধান ধর্ম ছিল জরথুষ্ট্রবাদ। এ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জরথুষ্ট্র যিনি আগুনকে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
জরথুষ্ট্রীবাদে আহুরা মাজদা সর্বোচ্চ সত্তা, ধর্মগ্রন্থের নাম — আভেস্তা। মূল বিশ্বাস হলো–সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, ন্যায়পরায়ণ ঈশ্বর আহুরা মাজদাকে পূজা করা। মন্দ শক্তি অংগ্রা মাইনিউ বা আহরিমান এর বিরুদ্ধে লড়াই করে ন্যায়পরায়ণ থাকা।
মানুষের ভূমিকা হলো প্রতিটি মানুষকে সৎচিন্তা সৎকথা ও সৎকর্ম দ্বারা সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। জরথুষ্ট্রীবাদে আত্মা ও পরকালের ধারণা হলো মৃত্যুর পর আত্মা চিনভাত ব্রিজ অতিক্রম করে, ন্যায়পরায়ণ আত্মা স্বর্গে যায়, অন্যথায় নরকে পতিত হয়। সুফি বা দরবেশ শব্দগুলো প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্যের অগ্নিপূজক ধর্মের পুরোহিত তন্ত্র বা আধ্যাত্মিকতার প্রতিশব্দ।
প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্যের হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য ছিল অগ্নি উপাসনা নিয়ে। দেশের সর্বত্রই অসংখ্য অগ্নিমণ্ডপ ও নির্দিষ্ট পূজারী বা পুরোহিত ছিল। এমনকি সম্রাটের রাজপ্রাসাদেও অগ্নিমণ্ডপ স্থাপন করা হয়েছিল। অগ্নিকে সাক্ষী রেখে তারা যেকোনো শপথ বাক্য পাঠ করত।
পারস্যের সাসানী রাজবংশের শাসকেরা সকলেই জরথুষ্ট্রবাদ বা অগ্নিপূজক ধর্মমতে বিশ্বাসী ছিলেন। এ কারণে পারস্য সম্রাজ্যের সকল অঞ্চলগুলোতে অগ্নি পূজার ব্যাপক প্রচলন ছিল এবং সকলেই অগ্নি উপাসক বলে পরিচিত ছিল। অগ্নি উপাসকরা পুরোহিততন্ত্রের ধারাবাহিকতা খুব ভালোভাবেই মেনে চলত।
জরথুষ্ট্রীয় বা অগ্নি উপাসকরা একেশ্বরবাদী প্রবণতাকে ধারণ করলেও ধর্মীয় রীতিনীতি ও অগ্নি পূজাকে কেন্দ্র করে পুরোহিতকেন্দ্রিক সমাজ গড়ে উঠেছিল। জরথুষ্ট্রবাদ নৈতিকতার উপর জোর দিলেও পরে এটি আনুষ্ঠানিকতা ও পুরোহিততন্ত্রে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, যা সমাজে বৈষম্য ও গোঁড়ামি সৃষ্টি করেছিল। শাসকেরা পুরোহিতদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে ধর্মকে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে এনে সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল। প্রজা সাধারনের মৌলিক অধিকারগুলো ধর্মীয় রোশানলে পুড়ে ছারখার হচ্ছিল, প্রতিকারের কোন ব্যবস্থা ছিল না।
সাসানী প্রভুরা সমস্ত সাম্রাজ্যব্যাপী একক প্রভুত্ব কায়েম করেছিল। অন্যান্য সকল জাতিগোষ্ঠী সাসানী প্রভুদের পদতলে পিষ্ট হচ্ছিল। ধর্ম তাদেরকে এসকল জুলুম অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে পারেনি। ধর্মমত পরিচালিত হতো রাজ আজ্ঞা অনুসারে। এভাবেই দেখা যায় পারস্য সম্রাজ্যের প্রতিটি অঞ্চলের সর্বসাধারণ মানুষ জরথুষ্ট্রীয়বাদের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল।
4. আরব উপদ্বীপ ও পৌত্তলিকতা
ইসলামের আগমনের আগে আরব উপদ্বীপে গোত্রভিত্তিক পৌত্তলিক ধর্মচর্চা প্রচলিত ছিল। আরবের অধিবাসীরা নিজেদেরকে দ্বীনে ইব্রাহিমের অনুসারী মনে করলেও গোত্র
ভিত্তিক তারা বিভিন্ন ধরনের দেব দেবীর পূজা করত। কিন্তু তাদের মনে আল্লাহর বিশ্বাস ছিল এজন্যই তারা কাবাঘরকে বাইতুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর বলতো। আল্লাহর ভালোবাসা কিংবা অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য তারা বিভিন্ন দেব–দেবীকে মাধ্যম হিসেবে পূজা করত দেবতার পূজার মাধ্যমেই তারা আল্লাহর সাহায্য কামনা করত।
মক্কার কাবা ঘরে ৩৬০টিরও বেশি মূর্তি ছিল এবং প্রতিটি গোত্রের নিজস্ব দেব–দেবী ছিল। তারা মনে করত একজন আল্লাহর পক্ষে পৃথিবীর সকল কিছু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। দেবতারা হচ্ছে আল্লাহর সাহায্যকারী, সহায়ক শক্তি। একেকজন দেবতাকে এক একটি দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে, যে দেবতাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সে দেবতা সে দায়িত্বের মালিক। অতএব পূজার মাধ্যমে দেবতাকে খুশি করতে পারলে দেবতা কর্তৃক শক্তি পাওয়া যায়। দেবতা খুশি হলে আল্লাহর নিকট মানুষের জন্য সুপারিশ করে।
কন্যা সন্তানের পিতা হওয়া লজ্জাজন, মনে করে আরব সমাজে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়া, নারী অবমাননা, মদ্যপান, জুয়া, লুণ্ঠন ও গোত্র–যুদ্ধ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তারা আবার কাবা ঘর তাওয়াফ, হজ ও কোরবানিও করত। তারা নিজেদেরকে দ্বীনি ইব্রাহিমের অনুসারী বলে দাবি করার পরও দেবতাকে খুশি করার জন্য দেবতার নামে পশু উৎসর্গ করত, দেবতার পূজা করত।
মরুভূমির শত প্রতিকূল পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও আরব উপদ্বীপের অধিবাসীরা ছিল স্বাধীনচেতা, তারা কারো অধীনতা বা আনুগত্য স্বীকার করত না। গোত্রীয় ঐক্য ছিল তাদের শক্তির প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। তদানীন্তন পৃথিবীর দুই পরাশক্তি রোমান সাম্রাজ্য এবং পারস্য সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্যবাদী ঢেউ আরবের মরুতে এসে বিলীন হয়ে যেত। এই দুই সম্রাজ্যের কোন সাম্রাজ্যই আরব উপদ্বীপকে আনুগত্যের শৃঙ্খলে আনতে পারেনি।
আরবের নিজস্ব কৃষ্টি কালচার ঐতিহ্য ছিল। এখানে ধর্মীয় নিপীড়ন কিংবা পুরোহিততন্ত্র না থাকলেও গোত্রে গোত্রে বিবাদ দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। আরবের সাধারণ মানুষও মুক্তির পথ খুঁজছিল, মুক্তির অপেক্ষায় অন্ধকারাচ্ছন্ন আরব ঊষার আলোর দিকে তাকিয়ে ছিল।
৪. ভারতবর্ষে ধর্মীয় অবস্থা
দ্বীনইসলামআগমনেরপূর্বেভারতীয়উপমহাদেশেধর্মীয়বৈচিত্র্যছিলঅত্যন্তজটিল।ভারতীয়উপমহাদেশেপ্রধানধর্মছিলবৈদিকধর্ম।বৈদিকধর্মেদেবতা,মন্দির, মূর্তি
কিংবা পূজার কোন উল্লেখ পাওয়া না গেলেও কালের বিবর্তনে দেবতা, মন্দির মূর্তি ও পূজার পদ্ধতি এই ধর্মের অংশ হয়ে যায়। একেশ্বরবাদ থেকে বহু ঈশ্বর তথা বহু দেবদেবীর ও মূর্তি পূজার মধ্য দিয়ে একেশ্বরবাদী ধর্মের পরিবর্তে মুশরেক বা মূর্তিপূজক ধর্মে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
মূর্তি পূজার দিক দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ এবং আরব উপদ্বীপের ধর্মীয় মতাদর্শ একই ছিল। আরবের জনগণ প্রকৃতপক্ষে দ্বীনে ইব্রাহিমের অনুসারী বলে এক আল্লাহকে মুখে স্বীকার করলেও আল্লাহর সাহায্যকারী ও সহায়ক মনে করে অসংখ্য দেব–দেবীকে মান্য করতো ও তাদের মূর্তি বানিয়ে মূর্তি পূজা করত। তেমনিভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের অধিবাসীরা বৈদিক ধর্ম, বৌদ্ধ কিংবা জৈন ধর্ম অনুযায়ী এক ঈশ্বরের কথা যাই বলুক না কেন, প্রত্যেককেই ঈশ্বরের অংশ বা অবতার হিসেবে অসংখ্য দেব–দেবীকে মান্য করতো ও তাদের মূর্তি বানিয়ে মূর্তির পূজা করত।
ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মীয় রীতিনীতির মারপ্যাঁচে পড়ে সাধারণ জনগণ বর্ণপ্রথায় বিভক্ত হয়ে যায়। ফলে জাত পাতের ভেদাভেদ ও আচারনিষ্ঠ জীবনের কারণে সামাজিক বিভক্তি চলে আসে। ব্রাহ্মণ্য পুরোহিততন্ত্র সমাজ নিয়ন্ত্রণ করত। রাষ্ট্র বা রাজারা পুরোহিতদেরকে নিয়ন্ত্রণ করত। ফলে ধর্মীয় রীতি–নীতির মারপ্যাঁচে সাধারণ মানুষের অবস্থা হয়েছিল ত্রাহি ত্রাহি।
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মমত বিস্তৃতভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত ছিল, এই ধর্ম দুটি অহিংসা ও আধ্যাত্মিকতার উপর গুরুত্বারোপ করত। এই দুই ধর্মের নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৃষ্টি–কালচার ছিল। ধর্মীয় পুরোহিত ও রীতিনীতি ভিন্ন হওয়ার কারণে হিন্দু ধর্মের সাথে ওই দুই ধর্মের বিরোধ চলছিল।
এই তিন ধর্মমতের অনুসারীরা ভারতীয় উপমহাদেশে অনেক অঞ্চলে রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল। ফলে নিজ নিজ ধর্মমতের আনুকূল্যে শাসকগণ প্রজা সাধারণের ধর্মীয় রীতিনীতি প্রয়োগ করত। পুরোহিতগণ রাজআজ্ঞা অনুযায়ী ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনা করত। এ কারণে দেখা যায় এই তিন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে সর্বদাই বিভেদ দেখা দিত। এক ধর্মমত অন্য ধর্মততকে সহ্য করতে পারত না। হিন্দু ধর্ম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় এবং রাজ অনুগ্রহ পাওয়ার কারণে অতি দ্রুত বৌদ্ধ ধর্ম ও জৈন ধর্মের উপর ধর্মীয় নিপীড়ন ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু করে। ইসলাম আগমনের পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মমতে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয়। এই দুই ধর্মের মানুষ ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে নির্বাসিত হয়, তাদেরকে হত্যা করে করে বিতাড়িত করা হয়। এভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের সাধারণ মানুষ
ধর্মীয় বিভেদ, পুরোহিততন্ত্রের গোড়ামী,ও বর্ণপ্রথার রীতিনীতির যাতা কলে পিষ্ট হচ্ছিল।
৫। দ্বীন ইসলামের আগমন
ইসলাম আগমনের পূর্বে পৃথিবীর প্রধান ধর্মগুলো (খ্রিস্টধর্ম, জরথুষ্ট্রবাদ, হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, পৌত্তলিকতা) মানুষের মধ্যে কিছু নৈতিক মূল্যবোধ তৈরি করলেও সেগুলোর সাথে ধর্মীয় গোঁড়ামি, পৌরহিত্যের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি, বর্ণপ্রথার দোহাই দিয়ে শাসন শোষণ ও সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করে সর্বসাধারণের নিকট ধর্মকে শান্তি ও স্বস্তির পরিবর্তে শাস্তি ও অশান্তির বিধি–বিধানে পরিণত করেছিল। ফলে মানবজাতি একটি নতুন দিশার অপেক্ষায় ছিল। ইসলামের আবির্ভাবে মজলুম মানবতা সেই পথের দিশা খুঁজে পায়।
এভাবে আমরা যদি ইসলাম আগমনের পূর্বে পৃথিবীব্যাপী ধর্মীয় অবস্থান খুঁজি তাহলে এক কথায় বলা যায় রোমান সাম্রাজ্যের ভূমি ছিল খ্রিস্ট ধর্মের, পারস্য সম্রাজ্যের ভূমি ছিল অগ্নি উপাসকদের, আরব ভূখণ্ড ও ভারতীয় উপমহাদেশের ভূমি ছিল মূর্তিপূজক বা মুশরেকদের। এই ধর্মমত গুলো মধ্যযুগের আগে ও পরে সমস্ত পৃথিবীর শাসন কর্তৃত্ব নিয়ন্ত্রণ করত।(আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার ভূখণ্ড আমাদের অজানা ছিল) যুগের পর যুগ ধরে এ ধর্মমত গুলো নিজ নিজ ভূখণ্ড আঁকড়ে ধরে সেই ধর্মমত অনুযায়ী কৃষ্টি–কালচার ইতিহাস ঐতিহ্য গড়ে তুলেছিল। ইতিহাসে দেখা যায় পৃথিবীর ওই দুই পরাশক্তি অনেক সময় একে অন্যের ভূমি দখল করেছে, দীর্ঘ সময় দখলকৃত অঞ্চল নিজদের আয়ত্তে রেখেছে কিন্তু বিজিত অঞ্চলে বিজয়ীদের ধর্মমত বা কৃষ্টি কালচার প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি।
একথা সত্য যে, সে সময় পৃথিবীতে প্রচলিত ধর্মমতগুলো বিপরীত মতের কোন জনগোষ্ঠীকে স্বেচ্ছায় নিজেদের ধর্ম মতে বিশ্বাসী করাতে পারেনি। স্বাভাবিক নিয়ম ছাড়াও বিজয়ী শক্তি বিজিত অঞ্চলে প্রভাব প্রতিপত্তি দ্বারা কেউ কখনো নিজেদের ধর্মমত কিংবা কৃষ্টি–কালচার প্রতিষ্টা করতে পারেনি। একে অপরকে পরাভূত করেছে কিন্তু একে অন্যকে নিজের ধর্মমত বা কৃষ্টি কালচার গ্রহণ করাতে পারেনি।
এসকলধর্মমতেরবিপরীতস্রোতধারানিয়েদ্বীনইসলামপৃথিবীতেআগমনকরেছিল।এসকলধর্মমতেরসাথেদীনইসলামেরকোনসাদৃশ্যবামিলছিলনা।সম্পূর্ণবৈরীএকপরিবেশেদ্বীনইসলামবিকশিতহয়েছিল।হঠাৎকরেদ্বীনইসলামেরআগমনেআরবভূখণ্ডেরসর্বসাধারণনিজেদেরধর্মমতকেপরিত্যাগকরেদ্বীনইসলামগ্রহণ
করেনি । বরং তাদের নেতৃবৃন্দ যথা সর্বস্ব দিয়ে দ্বীন ইসলামের বিরোধিতা করেছে। দ্বীন ইসলামের অনুসারীদের উপর অমানুষিক জুলুম নির্যাতন করেছে, এমনকি একই গোত্রের মানুষ হওয়ার পরেও দ্বীন ইসলামের অনুসারী হওয়ার কারণে যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে শক্তির দাপটে তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টাও তারা বারবার করেছে।
পরিশেষে সেই আরববাসি দীন ইসলামের সৌন্দর্য, ভাতৃত্ব, ভালোবাসা ও মানবিক গুণাবলীতে মুগ্ধ হয়ে দলে দলে দ্বীন ইসলাম কবুল করে নিয়েছে। জাতিগতভাবে আরবীয় জনগণ দীন ইসলাম গ্রহণ করেছে, শুধু তাই নয় আরববাসীরা নতুন এই ধর্মমত দ্বীন ইসলামের পতাকা নিয়ে পৃথিবীর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভুখা নাঙ্গা মরুচারী আরবরা বিশ্বের দুই পরাশক্তি রোমান সাম্রাজ্য ও পারস্য সাম্রাজ্যের সাথে একই সাথে টক্কর দিয়ে তাদের ভূমি দখল করে নিয়েছে।
শুধু ভূমি দখল করে নিলে কথা ছিল না, সবচেয়ে বড় কথা হলো মরুচারী ওই ইসলামী খেলাফতের বাহিনী পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও উন্নত অঞ্চলের গণমানুষের মন জয় করে তাদেরকে নিজেদের অনুসারী বানিয়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয় প্রাক্তন রোমান সাম্রাজ্য ও পারস্য সাম্রাজ্যের প্রজাবৃন্দও তাদের পরবর্তী প্রজন্ম দ্বীন ইসলামের এমন অনুসারী হয়েছে যে তারা তাদের পূর্বের শাসক বা সম্রাটের বিরুদ্ধেও যুদ্ধের ময়দানে রুখে দাঁড়িয়েছে। এটাই ছিল মধ্যযুগের প্রথম ভাগে পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা।
আশ্চর্যজনক ঘটনা এ কারণেই যে, এমনটা নয় আরবরাই প্রথম কোন ভূখণ্ড দখল করেছে। এর আগেও অনেক রাজা–বাদশা সাম্রাট একে অন্যের দেশ, ভূখণ্ড কিংবা জনপদ দখল করেছে। কিন্তু কোন বিজয়ী শাসকই বিজিত অঞ্চলের জনগণের ধর্মমত এবং কৃষ্টি কালচার পরিবর্তন করতে পারিনি।
এক্ষেত্রেই দ্বীন ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব, দ্বীন ইসলামের অনুসারীদের কৃতিত্ব সর্বদাই পৃথিবীর অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রজন্মের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। দ্বীন ইসলাম তথা ইসলামী খেলাফতের বাহিনী পৃথিবীর যে অঞ্চলেই প্রবেশ করেছে সেই অঞ্চলের সেই জনপদের মানুষের ধর্মমত কৃষ্টি–কালচার পরিবর্তন করে দিয়েছে। এটা কখনোই জোরপূর্বক করা যায় না, জোরপূর্বক হলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম দ্বীন ইসলামের অনুসারী বৃদ্ধি পেত না, ক্ষয়স্নু হয়ে যেত। হাজার বছর ধরে চাপিয়ে দেওয়া ধর্মমত কৃষ্টি কালচার বা আদর্শের উপর কোন জাতি গোষ্ঠী বা জনপদের অধিবাসী অটল থাকতো না। চলবে……